আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৭৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ঘোষিত আসনে প্রার্থীর তালিকায় রয়েছে বিএনপির প্রয়াত, সাবেক ও বর্তমান নেতাদের ২৪জন ছেলে ও মেয়ে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯জন ছেলে, ৫জন মেয়ে। প্রয়াত দুই নেতার স্ত্রীরাও পেয়েছেন মনোনয়ন। মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য প্রফেসর ডক্টর খোন্দকার আকবর হোসেন বাবুল। মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে পাঁচ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন তাঁর পিতা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-১ আসনে খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।
২০১১ সালে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর এলাকাবাসীর দাবিতে এবং বেগম খালেদা জিয়ার আহবানে খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু সরাসরি রাজনীতিতে যোগদান করেন। পিতার মৃত্যুর আগে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও পিতার নির্বাচনি প্রচার-প্রচারনাসহ নানা সময় তিনি এলাকাবাসীর পাশে ছিলেন। রাজনীতিতে যোগদানের পর বিগত পনেরো বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে তিনি হরতাল, অবরোধ সহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, এবং দুঃসময়ে পাশে ছিলেন।
বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জাগদলে যোগদানের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। তিনি জাগদলের প্রথম ৭১ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৮ সালে মানিকগঞ্জ জেলা (সাংগঠনিক) জাগদলের আহবায়ক ও জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ ও ১৯৮৯ সালে তিনি মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, শামসুল হুদা ও ডা: মতিনের মাধ্যমে ঢাকার মিরপুরের বিউটি সিনেমা হলে বিএনপির নামে একটি সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী দলকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করেছিলেন। তখন শহীদ জিয়ার রাজনীতিকে সমুন্নত রাখতে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। এমনকি ওই সময়েও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপিতে একটি বিপর্যয় এসেছিল। তখনও তিনি জেলার নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিএনপির মূলধারার পক্ষে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করে মানিকগঞ্জ বিএনপিকে একটি শক্তিশিলী সংগঠনে পরিণত করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া যে সংস্কারের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন তাতেও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাড়া দেননি। বরং ষড়যন্ত্রকারীদের হীন অপচেষ্টার তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন।
সংসদে চীফ হুইপের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তিনবার সফলতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে অনেকেই মন্ত্রীর পদে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেইবারও তিনি চীফ হুইপের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এতেও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মন খারাপ বা অভিমান না করে চীফ হুইপের দায়িত্ব আরও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। এই ঘটনাটি এবং আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার সংস্কারের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের হীন অপচেষ্টার তীব্র বিরোধীতায় দলের প্রতি ও দলীয় নেত্রীর ওপর তাঁর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে।
ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের “মাইনাস টু” এর নামে বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার হীন অভিসন্ধি ও দলের মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার সংস্কার প্রস্তাবসহ নানা ষড়যন্ত্রে দল যখন বিপর্যয়ের মুখে তখন দলকে রক্ষায় বেগম খালেদা জিয়া আস্থাভাজন হিসেবে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করেন। ওই সময় বিভিন্ন সংস্থা ও মহল খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য হেন চেষ্টা নেই যা করেনি। এমন চাপের মুখেও তিনি সেদিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন-“তাঁর মৃত্যু হতে পারে তবুও তাঁকে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সরানো যাবে না”। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও ওয়ান ইলেভেনের সরকারের ষড়যন্ত্রের মুখে হিমালয়ের মতো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে দলের জন্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন যে ভূমিকা রেখে গেছেন তা অতুলনীয় এবং ইতিহাসে স্বার্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।খোন্দকার দেলোয়ারের কনিষ্ঠ কন্যা ডা: দেলোয়ারা বেগম পান্না এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া) যদি সুস্থ থাকতেন এই নমিনেশন কোনোভাবেই জিন্নার কাছে যেতে পারত না, ম্যাডাম অসুস্থতার কারণে এই সুযোগ ব্যবহার করে কিছু কুচক্রি মহল জিন্নাকে নমিনেশনটা পাইয়ে দিয়েছে। আমার আব্বা অত্যন্ত সৎ ছিল, আমরা স্বাভাবিকভাবে চলি এবং একটি আদর্শ নিয়ে চলি। বিএনপিকে যারা ডুবানোর জন্য চেষ্টা করছে তারাই হয়তো এই কাজটা করেছে। যোগ্য প্রার্থী দিতে হবে, আমি আমাদের যোগ্য নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অনুরোধ করব বিষয়টি দেখার জন্য।’ বিএনপির দুঃসময়ের কান্ডারি ও বেগম খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাঁর সমর্থক ও জেলা বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন বিএনপির এই মনোনয়ন এবং দেলোয়ার হোসেনের পরিবারের প্রতি এই আচরণ বিএনপির তৃণমূলে নতুন বিতর্কের তৈরি করবে।



